অনাবৃষ্টির_গল্প

অনাবৃষ্টির_গল্প
মোঃ মনিরুল ইসলাম
.
বৃষ্টির যেন আর তর সইছিল না। এতো তাড়া কিসের কে জানে!
রিকশায় চড়লে অনায়াসেই আকাশ দেখা যায়। আজকে আকাশ দেখতে ভালো লাগছে না। ঘন কালো মেঘে আকাশটা ছেয়ে গেছে। এই ভরদুপুরেও শহুরে পথঘাট ছায়াময় হয়ে উঠেছে। চারপাশে আদ্র বাতাস বইছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি হবে, তবুও বৃষ্টি হচ্ছে না। সবমিলিয়ে কেমন যেন মন বিষণ্ণ করা পরিবেশ।
রাস্তার বামপাশ ধরে রিকশা এগোচ্ছিল। ডানপাশে জে ইউ কমপ্লেক্স। প্রচণ্ড ভিড় থাকায় রিকশাচালক রাস্তার অপরপাশে যেতে সমর্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে বামপাশেই নামতে হল। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হতে গেলাম। অর্ধেক রাস্তা পার হতেই শুরু হলো ঢল। মুহূর্তেই হেঁটে চলা মানুষজন ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে দুপাশে চলমান সারি সারি গাড়ির মাঝে আটকে গেলাম। অগত্যা সামনে না গিয়ে কোনোক্রমে পিছনে ফিরে একটা ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে বেশ ভিজে গেছি।
ছাউনিতে আরো অনেক লোকজন। পাশের দোকান থেকে একটা সিগারেট এনে ধরালাম। দুটো সময় আমার সিগারেট ফুঁকতে ভালো লাগে। এক হলো মাঝরাতে; আর এক বৃষ্টির সময়।
রাস্তায় এখন কেউ হাঁটছে না। একটা কাঁক তারের উপর বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে একবার ধোঁয়া ছাড়লাম। "হিমেল! এই হিমেল!" একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর আমার নাম ধরে ডাকছে। ডানদিক থেকে শব্দটা কানে এলো। আবার শুনলাম, "এই হিমেল!" ডানপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। দূরে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়লো। হৃদয়ের ছোট্ট কুঁড়েঘরে ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল। একি বৃষ্টি! কতদিন পর দেখছি! চার বছর তো হবেই।
সেই মুখ, সেই চোখ, সেই ঠোঁট। কেমন আছে বৃষ্টি? গালের পাশে দাগটা কিসের? এসব জানার অধিকার কি আমার আছে! কিংবা বৃষ্টির কোমর অবধি লম্বা চুল এত ছোট হলো কিভাবে? বৃষ্টি কি জানে ওর লম্বা চুলগুলো আমার কতটা ভালো লাগতো! একি সত্যিই বৃষ্টি! নাকি অন্যকেউ! একই সাথে বিভিন্ন ধরনের ভাবনা আমাকে গ্রাস করলো।
আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, "কেমন আছো হিমেল?" আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। নিশ্চিত হলাম এটা বৃষ্টিই।
"ভালো।" বৃষ্টি কেমন আছে তা জানতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয় মানুষের সুখও কখনো কখনো অসুখের কারণ হয়।
"তুমি তো একেবারে ভিজে গেছ। ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো!" বৃষ্টির কথাবার্তা একদম স্বাভাবিক। শুনে বোঝার উপায় নেই যে আমাদের এতদিন পর দেখা হল। মনে হচ্ছে যেন এখনি সে তার শাড়ির নীল আঁচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দেবে।
"কিচ্ছু হবে না। আমি ঠিক আছি।" বলেই ঠোঁটে সিগারেট ছোঁয়ালাম।
"আবার সিগারেট ধরেছ!"
"হুম। খাবে?" কয়েকবছর আগে এভাবে বললে হয়তো সে আমার দুই আঙুলের মাঝ থেকে সিগারেট ছিনিয়ে নিয়ে পায়ে পিষে ফেলতো। হয়তো বৃষ্টিও জেনে গেছে, এখন তার অধিকার নিতান্তই একজন সাধারণ পরিচিতার সমান। চোখের আড়াল হলে অধিকারও একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়।
"আমাকে সিগারেট সাধতে তোমার লজ্জা করছে না?" কৃত্রিম রাগ দেখালো বৃষ্টি। দূর আকাশের মৃদু বজ্রধ্বনিতে যেন তাঁর সে রাগ প্রতিধ্বনিত হলো।
"সিরিয়াসলি বলছি। বৃষ্টির সময় সিগারেট ফুঁকতে অমৃতের মত লাগে।"
"অমৃত না ছাই!! কেন যে খাও এসব? চেহারার একি এক হাল বানিয়েছ! একদম বনমানুষের মতো দেখাচ্ছে।"
"ভাবছি বনেই চলে যাবো। এই লোকালয় আর ভালো লাগে না।"
"হ্যাঁ তাই করো।"
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বৃষ্টি অন্যদিকে চোখ সরালো। আমার সাথে কথা বলতে আসাটা যে তাঁর চরম ভুল হয়েছে তা বোধহয় সে এতক্ষণে বুঝে গেছে।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফিল্টার ফেলে দিলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, "তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। আর্কিটেক্ট স্বামী কি খেতে দেয় না?"
"ডায়েট করছি তো। তুমিও কেমন যেন হয়ে গেছ। আমি তো প্রথমে তোমাকে চিনতেই পারিনি।"
"না চেনাটাই স্বাভাবিক। মানুষ চেনা তো সহজ কথা নয়।"
"তবে তুমি এখনো বদলাও নি। বাঁকা কথা বলার অভ্যাস এখনো আছে। কী হল? হাসছো কেন?"
"তোমার কথা শুনে হাসছি। তা তুমি কোথায় গিয়েছিলে? দেশে ফিরলে কবে?"
"পনের তারিখে। ও একমাসের ছুটি পেয়েছে। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। বৃষ্টি থামলে বাসায় যাবো। সামনের সপ্তাহে এখান থেকে ঢাকা যাব। সেখানে চার পাঁচদিন থেকে আবার চলে যাবো। তুমি কী করছো এখন?"
"একটা ছোটখাটো চাকরি পেয়েছি। দিন চলে যাচ্ছে।"
আকাশ চুইয়ে বৃষ্টি পড়ছে মাধ্যাকর্ষণের টানে। রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমছে। বৃষ্টি বললো- "এই শহরটা এমন কেন? একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট সুইমিংপুল হয়ে যায়। নোংরা-কাদা কি বিশ্রী!!"
"এই শহরটাই একসময় তোমার প্রিয় ছিল। এখানে তো তবু বৃষ্টি হয়। তুমি যে দেশে থাকো সেখানে নাকি বৃষ্টিই হয় না।"
"হুম।"
"আচ্ছা, তুমি কি ওখানেই থেকে যাবে? দেশে একেবারে ফিরবে না?"
"ইচ্ছা নেই। কিছু দিনের মধ্যেই সম্ভবত সিটিজেনশিপও পেয়ে যাবো। আচ্ছা, আগেরবার এসে তোমার বিয়ের খবর শুনেছিলাম।"
"ঠিকই শুনেছ।"
"তোমার বউ তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাই না!"
"জানি না সঠিক।"
"আর তুমি?"
"ভালোবাসা বলে কিছু নেই। সবই অলীক কল্পনা। তুমি আর আমি আজ যার যার মতো ভূখণ্ড বেছে নিয়েছি। সিটিজেনশিপ পেয়েছি। মনের চারিদিকে কাঁটাতারে ঘিরে রেখেছি। বেশ ভালোই আছি। অভ্যস্ততার ভেতর দিয়ে দিন চলে যাচ্ছে।"
"তারপরেও, তোমরা কেউ কাউকে বলো নি কখনো?"
"মুখে বলা তো সহজ কাজ। সবাই বলতে পারে। কি চমৎকার মিথ্যেগুলো!"
"এখনো এত অভিমান তোমার! আমাকে আর লজ্জা দিও না।"
"তুমি ঠিকই করেছ। লজ্জা পাবার কিছু নেই। তোমার জায়গায় আমি থাকলেও তাইই করতাম।"
বৃষ্টি চুপ করে আছে। বৃষ্টি এখনো কমেনি। পরিবেশটা ভালো লাগছে না। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছি। বললাম, "এখন কোথায় যাবে?"
"বাসায় যাবো। ওর জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি?"
"জানি না কোথায় যাবো। তবে এখনই যাবো।"
"আর কিছুক্ষণ থাকো। এতো তাড়াহুড়া কিসের? ও এলে পরিচয় করিয়ে দিব।"
"সবসময় তো তুমিই তাড়াহুড়া দেখিয়েছ। তাছাড়া কী বলে পরিচয় করিয়ে দিবে? পুরনো প্রেমিক! বেচারা! হা হা হা হা। তার আর দরকার নেই। ভালো থেকো।"
বৃষ্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। দ্রুত প্রস্থান করলাম। এখনো বৃষ্টি থামেনি।
হাতের মুঠোয় বৃষ্টিজল আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পরেই হাত চুইয়ে গড়িয়ে পড়লো। বুঝলাম এ হাত বৃষ্টিকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।
একটা প্রাইভেট কার কাদাজল ছিটিয়ে দিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল। কাঁচের জানালার ওপাশে কি বৃষ্টিকে দেখলাম? নাহ্, অন্যকেউ হবে হয়তো।
অনেকদিন পর আজ বৃষ্টিতে ভিজছি। তবুও যদি সারাজীবনের অনাবৃষ্টি কিছুটা পূরণ হয়।

2 Comments

Previous Post Next Post